আল্লাহ তায়ালাকে ভয় করুন সুদ পরিহার করুন

আল্লাহ তায়ালাকে ভয় করুন সুদ পরিহার করুন

বর্তমানকালে সুদ সম্পর্কিত লেনদেন ব্যবসা-বাণিজ্যের একটি বিরাট অংশ জুড়ে পসিদ্ধ হয়ে গেছে। বড় আকারের প্রায় সকল ব্যবসা-বাণিজ্য নির্ভরশীল হয়ে গেছে সুদী লেনদেনের উপর। এ কারণে সুদের নিষেধাজ্ঞা সম্পর্কে কুরআন ও হাদীসের বর্ণনাগুলো যখন সামনে আসে তখন তা বুঝতে, বুঝাতে এবং মেনে নিতে অনেকের মনে দ্বিধা-সংশয়ের সৃষ্টি হয়। অনেকে এক্ষেত্রে নানা রকম কৌশলের আশ্রয় নিতে চেষ্টা করেন। এটা কোনো মুমিন-মুত্তাকীর জন্য আদর্শ পন্থা নয়। সুতরাং সকলের উচিত আল্লাহ তাআলার ভয়কে মাথায় রেখে পরকালের কথা চিন্তা করে ঠান্ড মাথায় বিষয়টি বুঝতে চেষ্টা করা, এর গুরত্ব উপলব্ধি করা এবং পবিত্র কুরআন ও হাদীসের নির্দেশনা শিরোধার্য করে নিয়ে নিজেদের কর্মজীবনের গতিপথ নির্ণয় করা এবং পরকালের পথ সুগম করা।

আরবী ভাষায় সুদের প্রতিশব্দ রিবা। বাংলাভাষায় ‘সুদ’ শব্দটি যেমন সুপরিচিত, তেমনি আরবী ভাষায়ও ‘রিবা’ শব্দের ব্যবহার বহুলপ্রচলিত। রাসূলে কারীম (সাঃ )এর নবুওত লাভ এবং কুরআন কারীম অবতীর্ণ হওয়ার পূর্বে আরবের জাহেলী যুগেও ‘রিবা’ শব্দটি প্রচলিত ছিল। শুধু তাই নয়, সে সময় রিবা অর্থাৎ সুদের লেনদেনও চালু ছিল। সূরা নিসার আয়াত থেকে জানা যায় যে, হযরত মূসা (আঃ) এর যুগেও ইহুদীদের মধ্যে সুদের লেনদেনের রেওয়াজ ছিল এবং মূসা (আঃ) এর নিকট আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে প্রেরিত গ্রন্থ তাওরাতেও ‘রিবা’ অর্থাৎ সুদের লেনদেনকে হারাম সাব্যস্ত করা হয়েছে।

ইসলাম রিবা’র নিষেধাজ্ঞার বিষয়টিকে কেবল নৈতিক বিবেচনার অধীনে রাখেনি; বরং তাকে পুরোপুরি আইনের মর্যাদা দিয়েছে। এ বিষয়ে বিদায় হজে নবী (সাঃ) ঐতিহাসিক ভাষণের সংশিষ্ট অংশটুকু বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। নবী করীম (সাঃ) বলেছেন-

أَلَا كُلّ شَيْءٍ مِنْ أَمْرِ الْجَاهِلِيّةِ تَحْتَ قَدَمَيّ مَوْضُوعٌ،... وَرِبَا الْجَاهِلِيّةِ مَوْضُوعٌ، وَأَوّلُ رِبًا أَضَعُ رِبَانَا رِبَا عَبّاسِ بْنِ عَبْدِ الْمُطّلِبِ، فَإِنّهُ مَوْضُوعٌ كُلّهُ

অর্থ: সাবধান! জাহেলিয়্যাতের প্রত্যেক বিষয় আমার দু’পায়ের নীচে।... জাহেলীযুগের ‘রিবা’ বাতিল। আর প্রথম রিবা, যা আমরা বাতিল করছি তা আমাদের রিবা; আব্বাস ইবনে আব্দুল মুত্তালিবের রিবা। তা পুরোটাই বাতিল। (সহীহ মুসলিম, হাদীস ১২১৮)

বর্তমান পৃথিবীতে দু’ধরনের সুদী লেনদেন বেশি প্রচলিত। এক মহাজনী সুদ, অর্থাৎ কেউ কোনো সাময়িক বা ব্যক্তিগত প্রয়োজনে কারও নিকট থেকে ঋণ নিলে এর বিপরীতে ঋণের অতিরিক্ত যে অর্থ নেওয়া হয়। দুই. বাণিজ্যিক সুদ, যা কোনো উৎপাদনমূলক কাজে গৃহীত ঋণের বিপরীতে নেওয়া হয়। পবিত্র কুরআন ও হাদীসের স্পষ্ট বর্ণনা- সর্বপ্রকার সুদ হারাম। কেউ কেউ প্রতারণা করে বলে থাকেন যে, পবিত্র কুরআনে যে ‘রিবা’ তথা সুদকে হারাম ঘোষণা করা হয়েছে, তার দ্বারা প্রথম প্রকারের সুদ অর্থাৎ মহাজনী সুদ উদ্দেশ্য, যা কোনো সাময়িক বা ব্যক্তিগত প্রয়োজনে গৃহীত ঋণের বিপরীতে নেওয়া হয়। তারা এই ধোঁকার ভিত্তি রেখেছে আরেক মিথ্যা দাবির উপর। তারা বলে, কেবল এ ধরনের সুদই নাকি রাসূলে কারীম (সাঃ) এর যুগে এবং পূর্ববর্তী জাহেলী যুগে প্রচলিত ছিল। তাই এরূপ সুদকেই কুরআনে কারীমে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বর্তমান যুগে প্রচলিত বাণিজ্যিক সুদ এর রেওয়াজ এবং লেনদেন নাকি সে যুগে ছিল না। সুতরাং তাদের ধারণা মতে এরূপ সুদ কুরআনে কারীমে বর্ণিত নিষেধাজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত নয়।

আরও অনেক ইতিহাসে পাওয়া যায়। অতএব কুরআনে কারীমে সুদের প্রতি যে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে তা সর্বপ্রকার সুদের ক্ষেত্রে প্রযাজ্য, এতে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। এখন আমরা দেখি, সুদ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে কারীমের ভাষ্য-

یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوا اتَّقُوا اللهَ وَ ذَرُوْا مَا بَقِیَ مِنَ الرِّبٰۤوا اِنْ كُنْتُمْ مُّؤْمِنِیْنَ فَاِنْ لَّمْ تَفْعَلُوْا فَاْذَنُوْا بِحَرْبٍ مِّنَ اللهِ وَ رَسُوْلِهٖ وَ اِنْ تُبْتُمْ فَلَكُمْ رُءُوْسُ اَمْوَالِكُمْ لَا تَظْلِمُوْنَ وَ لَا تُظْلَمُوْنَ

অর্থ: হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সুদের যা বকেয়া আছে তা ছেড়ে দাও, যদি তোমরা মুমিন হও। যদি তোমরা না ছাড় তবে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে যুদ্ধের ঘোষণা শুনে নাও। আর যদি তোমরা তাওবা কর তবে তোমাদের মূলধন তোমাদেরই। এতে তোমরা (কারও প্রতি) জুলুম করবে না এবং তোমাদের প্রতিও জুলুম করা হবে না। (সূরা বাকারা-আয়াত: ২৭৮-২৭৯)

اَلَّذِیْنَ یَاْكُلُوْنَ الرِّبٰوا لَا یَقُوْمُوْنَ اِلَّا كَمَا یَقُوْمُ الَّذِیْ یَتَخَبَّطُهُ الشَّیْطٰنُ مِنَ الْمَسِّ ذٰلِكَ بِاَنَّهُمْ قَالُوْۤا اِنَّمَا الْبَیْعُ مِثْلُ الرِّبٰوا ۘ وَ اَحَلَّ اللهُ الْبَیْعَ وَ حَرَّمَ الرِّبٰوا فَمَنْ جَآءَهٗ مَوْعِظَةٌ مِّنْ رَّبِّهٖ فَانْتَهٰی فَلَهٗ مَا سَلَفَ وَ اَمْرُهٗۤ اِلَی اللهِ وَ مَنْ عَادَ فَاُولٰٓىِٕكَ اَصْحٰبُ النَّارِ هُمْ فِیْهَا خٰلِدُوْنَ

অর্থ: যারা সুদ খায় তারা (কিয়ামতের দিন) সেই ব্যক্তির মতো দাঁড়াবে, যাকে শয়তান স্পর্শ দ্বারা পাগল করে। এটা এজন্য যে, তারা বলে, ক্রয়-বিক্রয় তো সুদের মতোই। অথচ আল্লাহ ক্রয়-বিক্রয়কে হালাল করেছেন এবং সুদকে করেছেন হারাম। যার নিকট তার প্রতিপালকের উপদেশ এসেছে এবং সে বিরত হয়েছে, তবে অতীতে যা হয়েছে তা তারই। আর তার ব্যাপার আল্লাহর এখতিয়ারে। আর যারা পুনরায় করবে তারাই জাহান্নামের অধিবাসী হবে। সেখানে তারা হবে চিরস্থায়ী। (সূরা বাকারা-আয়াত: ২৭৫)

فَبِظُلْمٍ مِّنَ الَّذِیْنَ هَادُوْا حَرَّمْنَا عَلَیْهِمْ طَیِّبٰتٍ اُحِلَّتْ لَهُمْ وَ بِصَدِّهِمْ عَنْ سَبِیْلِ اللهِ كَثِیْرًا وَّ اَخْذِهِمُ الرِّبٰوا وَ قَدْ نُهُوْا عَنْهُ وَ اَكْلِهِمْ اَمْوَالَ النَّاسِ بِالْبَاطِلِ وَ اَعْتَدْنَا لِلْكٰفِرِیْنَ مِنْهُمْ عَذَابًا اَلِیْمًا

অর্থ: ভালো ভালো যা ইহুদীদের জন্য বৈধ ছিল আমি তা তাদের জন্য অবৈধ করেছি; তাদের সীমালংঘনের জন্য, আল্লাহর পথে অনেককে বাধা দেওয়ার জন্য এবং তাদের সুদ গ্রহণের জন্য, যদিও তা তাদের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়েছিল; এবং অন্যায়ভাবে লোকদের ধন-সম্পদ গ্রাস করার জন্য। তাদের মধ্যে যারা কাফের তাদের জন্য মর্মন্তুদ শাস্তি প্রস্তুত রেখেছি। (সূরা নিসা-আয়াত: ১৬০-১৬১)

یَمْحَقُ اللهُ الرِّبٰوا وَ یُرْبِی الصَّدَقٰتِ وَ اللهُ لَا یُحِبُّ كُلَّ كَفَّارٍ اَثِیْمٍ

অর্থ: আল্লাহ সুদকে নিশ্চিহ্ন করেন এবং দানকে বর্ধিত করেন। আল্লাহ কোনো অকৃতজ্ঞ পাপীকে ভালোবাসেন না। (সূরা বাকারা-আয়াত: ২৭৬)

 

এরপর সুদের নিষেধাজ্ঞা সম্পর্কে রাসূলে কারীম (সাঃ) এর হাদীসসমূহ উল্লেখ করা হচ্ছে :

حَدَّثَنَا عُثْمَانُ بْنُ أَبِي شَيْبَةَ، وَإِسْحَاقُ بْنُ إِبْرَاهِيمَ، - وَاللَّفْظُ لِعُثْمَانَ - قَالَ إِسْحَاقُ أَخْبَرَنَا وَقَالَ، عُثْمَانُ حَدَّثَنَا جَرِيرٌ، عَنْ مُغِيرَةَ، قَالَ سَأَلَ شِبَاكٌ إِبْرَاهِيمَ فَحَدَّثَنَا عَنْ عَلْقَمَةَ، عَنْ عَبْدِ اللَّهِ، قَالَ لَعَنَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم آكِلَ الرِّبَا وَمُؤْكِلَهُ‏ قَالَ قُلْتُ وَكَاتِبَهُ وَشَاهِدَيْهِ قَالَ إِنَّمَا نُحَدِّثُ بِمَا سَمِعْنَا ‏

অর্থ: উসমান ইবনু আবূ শাইবাহ ও ইসহাক ইবনু ইবরাহীম (রহঃ) ’আবদুল্লাাহ (রাযিঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অভিশাপ দিয়েছেন সুদখোরের প্রতি ও সুদদাতার প্রতি। রাবী বলেন, আমি বললামঃ এর লেখকের প্রতি ও সাক্ষী দু’জনের প্রতিও। তিনি বললেন, আমরা কেবল তাই বর্ণনা করি যা আমরা শুনেছি।
(সহীহ মুসলিম-হাদিস:১৫৯৭)

عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ عَنْ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ اجْتَنِبُوْا السَّبْعَ الْمُوْبِقَاتِ قَالُوْا يَا رَسُوْلَ اللهِ وَمَا هُنَّ قَالَ الشِّرْكُ بِاللهِ وَالسِّحْرُ وَقَتْلُ النَّفْسِ الَّتِيْ حَرَّمَ اللهُ إِلَّا بِالْحَقِّ وَأَكْلُ الرِّبَا وَأَكْلُ مَالِ الْيَتِيْمِ وَالتَّوَلِّيْ يَوْمَ الزَّحْفِ وَقَذْفُ الْمُحْصَنَاتِ الْمُؤْمِنَاتِ الْغَافِلَاتِ

অর্থ: আবূ হুরাইরাহ্ (রাঃ) সূত্রে নবী (সাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, সাতটি ধ্বংসকারী বিষয় থেকে তোমরা বিরত থাকবে। সাহাবীগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! সেগুলো কী? তিনি বললেন, (১) আল্লাহর সঙ্গে শরীক করা (২) যাদু (৩) আল্লাহ্ তা‘আলা যাকে হত্যা করা হারাম করেছেন, শরীয়ত সম্মত কারণ ব্যতিরেকে তাকে হত্যা করা (৪) সুদ খাওয়া (৫) ইয়াতীমের মাল গ্রাস করা (৬) রণক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যাওয়া এবং (৭) সরল স্বভাবা সতী-সাধ্বী মু’মিনাদের অপবাদ দেয়া। (সহীহ বুখারী-হাদীস: ২৭৬৬)

حَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ الصَّبَّاحِ، وَزُهَيْرُ بْنُ حَرْبٍ، وَعُثْمَانُ بْنُ أَبِي شَيْبَةَ، قَالُوا حَدَّثَنَا هُشَيْمٌ، أَخْبَرَنَا أَبُو الزُّبَيْرِ، عَنْ جَابِرٍ، قَالَ لَعَنَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم آكِلَ الرِّبَا وَمُوكِلَهُ وَكَاتِبَهُ وَشَاهِدَيْهِ وَقَالَ هُمْ سَوَاءٌ

অর্থ: মুহাম্মাদ ইবনু সাববাহ, যুহায়র ইবনু হারব ও উসমান ইবনু আবূ শাইবা (রহঃ) .. জাবির (রাযিঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লা’নাত করেছেন সুদখোরের উপর, সুদদাতার উপর, এর লেখকের উপর ও তার সাক্ষী দু’জনের উপর এবং বলেছেন এরা সবাই সমান। (সহীহ মুসলিম-হাদিস:১৫৯৮)

এ ছাড়াও আরও অসংখ্য হাদীসে সুদ খাওয়া, সুদ দেওয়া এবং সুদের সাথে কোনোরূপ সংশ্লিষ্টতার ব্যাপারে সতর্কবাণী উচ্চারণ করা হয়েছে।

এই ভয়াবহতম হারাম কর্মটিকেই এখন বানিয়ে ফেলা হয়েছে অতি উপাদেয় একটি বিষয়। মতলববাজ লোকেরা সকল শ্রেণির মুসলমানদের এতে জড়ানোর জঘন্যতম কাজটি করে যাচ্ছে বিনা বাধায়।

আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে তাকওয়া ও হেদায়েতের পথে চলার তাওফীক দান করুন।
আমীন ইয়া রব্বাল আলামীন।

ব্লগে ফিরে যান

মতামত দিন