ইসলাম আগমনের পূর্বে নারীদের অবস্থান ছিল পুরুষের অনেক নিচে। নারীদের শুধু ভোগ ও বিলাসিতার সামগ্রী হিসেবে বিবেচনা করা হতো। তাদের না ছিল নিজস্ব কোন পরিচয় না ছিল কোন অধিকার। পণ্যের মতো তাদের বেচা-কেনা হতো। আবার অনেকে কন্যা সন্তান হলে জীবিত পুঁতে ফেলত। ইসলাম প্রথম কন্যা সন্তানকে সৌভাগ্যের প্রতীক হিসেবে ঘোষণা করেছে। তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক মর্যাদা প্রদান করেছে। নবীজি (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি তিনটি কন্যা সন্তান লালন-পালন করেছে, পুত্র সন্তানকে কন্যাদের ওপর প্রাধান্য দেয়নি, তাদেরকে উত্তম ও আদর্শ শিক্ষা দিয়েছে, তাদেরকে বিয়ে দিয়েছে, তাদের সঙ্গে ভালো আচরণ করেছে, সে জান্নাত লাভ করবে।(আবু দাউদ: ৫১৪৯)
মানব সমাজে পুরুষের যতটুকু অবদান রয়েছে নারীরও ঠিক ততটুকু ভূমিকা রয়েছে। এর একটি ছাড়া আমাদের মানব সমাজ অচল। বর্তমান সমাজে নারীদের যতটুকু সম্মান ও মর্যাদা দেয়া হয় অতীতে এই চিত্র ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। জাতি ও ধর্ম ভেদে নারীদের অবস্থান ভিন্ন হলেও তাদের ছিল না কোন সামাজিক ও অর্থনৈতিক মর্যাদা। আরবে যেমন কন্যা সন্তানকে জীবিত কবর দেয়া হত, সভ্যতার দাবিদার ইংল্যান্ডে ডাইনি বলে নারীকে পুড়িয়ে মারার আইন ছিল যা রদ করা হয় ১৭৩৬ সালে।ইংল্যান্ড ও ব্রিটেনে ১৯শ শতকের শেষ দিকে ও ২০শ শতকের শুরুর দিকে নারীরা সম্পত্তি অধিকার অর্জন করে। বিভিন্ন রাজ্যে "ম্যারিড উইমেন'স প্রপার্টি অ্যাক্ট" প্রণয়ন করা হয় যা বিবাহিত নারীদের নিজস্ব সম্পত্তি রাখার অধিকার প্রদান করে। জার্মানী নারীদের ১৯০০ সাল, সুইস নারীদের ১৯০৭, অষ্ট্রেলীয় নারীদের ১৯১৯ সালের আগে ছিল না কোনো উত্তরাধিকার সম্পত্তি। ভারতের হিন্দু উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী, ১৯৫৬ সালের হিন্দু উত্তরাধিকার আইনে নারীরা সম্পত্তি অধিকার লাভ করে। এর আগে নারীদের সম্পত্তিতে অধিকারতো ছিলই না বরং সতীদাহ এর মতো প্রথা প্রচলিত ছিল।
অথচ ইসলাম সৃষ্টির পর থেকেই বলে আসছে নারীদের অধিকারের কথা, তাদের উত্তরাধিকারের কথা, পর্দা ও শালীনতা বজায় রেখে নিজে উপার্জন করার কথা। আমাদের প্রিয় নবী,বিশ্ব মানবতার বন্ধু হযরত মুহাম্মাদ (সা.) ‘সভ্য পৃথিবীর’ও ১৩০০ বছর আগে বলে গিয়েছেন নারীর অধিকারের কথা। শুধু বলেই যাননি তিনি নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। তিনিই প্রথম ঘোষণা করেন একজন পূর্ণ বয়ষ্ক নারী নিজেই সম্পত্তির মালিক হতে পারেন এবং চাইলে কারও অনুমতি ছাড়াই সম্পত্তি হস্তান্তরও করতে পারবেন। তিনি আরও বলে গেছেন পবিত্র কোরআনে নারীদের উত্তরাধিকার সম্পর্কেে যে নির্দেশ এসেছে তা যেন যথাযথ ভাবে পালন করা হয়।
একজন নারীর উত্তরাধিকার ও সম্পত্তিতে তার অধিকার কেমন হবে তার স্পষ্ট বর্ণনা আল্লাহ কোরআন মাজিদে দিয়েছেন। কুরআনের বিভিন্ন সূরায় নারীর উত্তরাধিকার সম্পর্কে বিস্তারিত উল্লেখ করা হয়েছে, বিশেষ করে সূরা নিসা (সূরা ৪) এই বিষয়ে অনেক নির্দেশনা প্রদান করে।
সুরা আন-নিসা (৪:৭) এ বলা হয়েছে: "পুরুষদের জন্য রয়েছে তাদের পিতামাতা ও নিকটাত্মীয়দের রেখে যাওয়া সম্পত্তিতে অধিকার এবং নারীদের জন্যও রয়েছে তাদের পিতামাতা ও নিকটাত্মীয়দের রেখে যাওয়া সম্পত্তিতে অধিকার, যা সামান্যই হোক বা বেশি; এ হল নির্ধারিত অংশ।"
একজন নারী তার পিতা-মাতার সম্পত্তিতে কি পরিমান অংশ পাবেন তারও স্পষ্ট ধারণা কোরআনে দেয়া আছে। ‘আল্লাহ তোমাদেরকে তোমাদের সন্তানদের সম্পর্কে আদেশ করেন: একজন পুরুষের অংশ দু’জন নারীর সমান। আর যদি শুধু নারীই হয় দু-এর অধিক, তাহলে তাদের জন্যে ওই ত্যাজ্য মালের তিন ভাগের দুই ভাগ। আর যদি (কন্যা) একজনই হয় তাহলে সে জন্য অর্ধেক।’ (সুরা নিসা: ১১)। অর্থাৎ কোন নারীর যদি ভাই থাকে তাহলে তিন ভাগের এক ভাগ পাবেন কন্যা বাকি দুই ভাগ পাবেন পুরুষ। যদি কন্যা একাধিক হয় তাহলে পুরুষ পাবে অর্ধেক বাকি অর্ধেক কন্যাদের মধ্যে ভাগ হবে। আর যদি কোন ভাই না থাকে কন্যা একা হয় তাহলে কন্যা পাবে পিতা-মাতার রেখে যাওয়া অর্ধেক সম্পত্তি এবং কন্যা একাধিক হলে দুই তৃতীয়াংশ পাবে।
নারী যে শুধু পিতা মাতার সম্পত্তি পাবে তানা, স্বামীর রেখে যাওয়া সম্পত্তিতেও রয়েছে নারীর অংশ। পবিত্র কোরআনুল কারিমে এরশাদ হয়েছে, ‘স্ত্রীদের জন্য তোমাদের ত্যাজ্য সম্পত্তির এক-চতুর্থাংশ যদি তোমাদের কোনো সন্তান না থাকে। আর যদি তোমাদের সন্তান থাকে তাহলে তাদের জন্য হবে ওই সম্পত্তির আট ভাগের এক ভাগ।’। (সুরা নিসা: ১২)।
মা জীবিত থাকতে যদি সন্তান মারা যায় তার রেখে যাওয়া সম্পত্তিতে মায়ের অংশ থাকে। মা সম্পত্তির এক-ষষ্ঠাংশ পান যদি মৃত ব্যক্তির সন্তান থাকে। সন্তান না থাকলে এবং মৃত ব্যক্তির ভাই-বোনও না থাকলে, মা এক-তৃতীয়াংশ পান।
পৃথিবীতে যুগে যুগে গড়ে উঠেছে বহু সভ্যতা, সৃষ্টি হয়েছে বিভিন্ন ধর্মের যা পরবর্তিতে বিলীনও হয়ে গিয়েছে। নারীরা কোথাও সম্মান পেয়েছে কোথাও পায়নি। কিন্তু নারীকে উত্তরাধিকার হিসেবে ঘোষণা করেছে শান্তির ধর্ম ইসলাম। যেখানে খ্রীষ্ট ধর্মে পুত্র থাকলে কন্যা কোন সম্পত্তি পেত না । স্বামী মারা গেলে তাদের যদি সন্তান না থাকে ঐ মৃত লোকের সম্পত্তি পায় তার নিকটাত্মীয়রা তবুও মৃত ব্যাক্তির বিধবা স্ত্রী কোন সম্পত্তি পেত না। অথচ ইসলামি উত্তরাধিকার আইন ন্যায়বিচার ও সুষম বন্টনের উপর প্রতিষ্ঠিত। ইসলাম পূর্ববর্তী যুগে নারীদের যে অবস্থান ছিল তা থেকে তাদের মুক্তি দিয়ে সম্মান ও মর্যাদা প্রদান করেছে। ইসলামের আইন ও নীতিমালা নারীদের জন্য একটি নিরাপদ ও সুরক্ষিত পরিবেশ সৃষ্টি করেছে যেখানে তারা তাদের অধিকার এবং মর্যাদা লাভ করতে পারে। ইসলামের এই পরিবর্তন নারীদের সমাজে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান এবং ভূমিকা প্রদান করেছে।