তাওবা ইসলামের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ যা মানুষের আত্মশুদ্ধি ও আল্লাহর নৈকট্য লাভের অন্যতম উপায়। তাওবা শব্দের অর্থ হল ফিরে আসা বা প্রত্যাবর্তন করা। তাওবা করা মানে আল্লাহর কাছে ফিরে আসা, তার কাছে নিজের পাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা এবং পুনরায় সঠিক পথে চলার প্রতিজ্ঞা করা।
পৃথিবীতে সব মানুষই কিছু না কিছু ভুল করে থাকে। কেউ বড় বড় ভুল করে কেউবা ছোট ছোট ভুল করে। কেউ বুঝে করে কেউ না বুঝেই করে। এই পৃথিবীতে মানুষের সৃষ্টিই হয়েছে আমাদের আদি পিতা আদম (আ.) এর ভুলের কারনে। কিন্তু ভুল করার পরে যদি আমরা আমদের ভুল বুঝতে না পারি তাহলে শয়তান এবং মানুষের মধ্যে কোন পার্থক্য থাকলো না। যেমন আদম (আ.) তার ভুল বুঝতে পেরে আল্লাহর কাছে একনিষ্ঠ মনে তাওবা করেন আল্লাহর কাছে ক্ষমা চান আমাদেরও উচিত ছোট বড় সব ধরনের ভুলের জন্য আল্লাহর কাছে তাওবা করে নিজেকে পবিত্র করা। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘মানুষ মাত্রই গুনাহগার। আর গুনাহগারদের মধ্যে তওবাকারীরাই উত্তম।’ (ইবনু মাজাহ ৪২৫১)
তাওবাকারীকে আল্লাহ অধিক ভালোবাসেন।কোরআন মাজিদে আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ বেশি বেশি তাওবাকারীকে ভালোবাসেন।’ (সুরা বাকারা: আয়াত ২২২)
এই আয়াত থেকে আমরা বুঝতে পারি যারা আল্লাহর কাছে বেশি বেশি তাওবা করেন তারা আল্লার কাছে অধিক প্রিয়।
কুরআন ও হাদীসে তাওবার গুরুত্ব বহুবার উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ্ তাওবার গুরুত্ব ও তার প্রতিশ্রুতি সম্পর্কে বলেছেন:
"তোমাদের রব বলেছে, 'হে আমার বান্দারা, যারা নিজেদের প্রতি অন্যায় করেছে, তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিঃসন্দেহে আল্লাহ্ সমস্ত গুনাহ মাফ করেন। তিনি অত্যন্ত ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।'" (সূরা আয-যুমার: ৫৩)
হাদীসে এসেছে: "নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তাওবাকারীর তাওবায় এত বেশি আনন্দিত হন, যেমন এক ব্যক্তি যার উট হারিয়ে গিয়েছিল এবং তা পুনরায় ফিরে পেয়ে অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছিল।" (মুসলিম)
আমরা অনেকেই ভুল করার পরে হতাশায় ভুগি ভাবি আল্লাহ হয়তো ক্ষমা করবেন না। কিন্তু আল্লাহ পরম দয়ালু তিনি আমদের তার কাছে তাওবা করতে বলেছেন। আল্লাহ্ তাওবাকারীদেরকে ভালোবাসেন কারণ তারা তাদের ভুলগুলো স্বীকার করে এবং আল্লাহর পথে ফিরে আসার চেষ্টা করে। এটি আল্লাহর দয়া ও ক্ষমার প্রতীক। আল্লাহ্ তাওবার দরজা সব সময় খোলা রেখেছেন, যাতে মানুষ যে কোনো সময় তার কাছে ফিরে আসতে পারে। আল্লাহ বলেছেন,
"আর যারা অজ্ঞতাবশত মন্দ কাজ করে তারপর তৎক্ষণাৎ তাওবা করে এবং নিজেদের সংশোধন করে, নিশ্চয়ই তোমার রব তাদের জন্য এর পর অবশ্যই অতীব ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।" (সূরা আন-নাহল: ১১৯)
আল্লাহ এবং রাসুল আমাদের শুধু তাওবা করতেই বলেননি, কিভাবে করতে হবে তাও শিখিয়ে দিয়েছেন।
اَسْتَغْفِرُ اللّٰهَ الَّذِيْ لَا اِلٰهَ اِلَّا هُوَ الْحَيُّ الْقَيُّوْمُ وَأَتُوْبُ اِلَيْهِ
উচ্চারণ: আস্তাগফিরুল্লাহাল্লাজী লা ইলাহা ইল্লা হুওয়াল হাইয়ুল ক্বাইয়্যুমু ওয়া আতুবু ইলাইহি।
অর্থ: আমি আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করি, যিনি ছাড়া আর কোনো উপাস্য নেই। তিনি চিরঞ্জীব, চিরস্থায়ী। আমি তাঁর দিকে ফিরে আসি (তাওবা করি)।
اَسْتَغْفِرُ اللّٰهَ وَأَتُوْبُ إِلَيْهِ
উচ্চারণ: আস্তাগফিরুল্লাহা ওয়া আতুবু ইলাইহি।
অর্থ: আমি আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করি এবং তাঁর দিকে ফিরে আসি (তাওবা করি)।
رَبِّ اغْفِرْ لِيْ وَتُبْ عَلَيَّ إِنَّكَ (أنْتَ) التَّوَّابُ الرَّحِيْمُ
উচ্চারণ: 'রাব্বিগ্ ফিরলি ওয়া তুব আলাইয়্যা ইন্নাকা (আংতাত) তাওয়্যাবুর রাহিম।'
অর্থ: 'হে আমার প্রভু! আপনি আমাকে ক্ষমা করুন এবং আমার তওবা কবুল করুন। নিশ্চয় আপনি মহান তওবা কবুলকারী করুণাময়।'
সাইয়িদুল ইস্তেগফার
اَللّٰهُمَّ أَنْتَ رَبِّيْ لَا اِلٰهَ اِلَّا أَنْتَ خَلَقْتَنِيْ وَأَنَا عَبْدُكَ وَأَنَا عَلَى عَهْدِكَ وَوَعْدِكَ مَا اسْتَطَعْتُ أَعُوْذُ بِكَ مِنْ شَرِّ مَا صَنَعْتُ أَبُوْءُ لَكَ بِنِعْمَتِكَ عَلَيَّ وَأَبُوْءُ بِذَنْبِيْ فَاغْفِرْ لِيْ فَإِنَّهُ لَا يَغْفِرُ الذُّنُوْبَ إِلَّا أَنْتَ
উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা আন্তা রাব্বী লা ইলাহা ইল্লা আনতা খালাকতানী ওয়া আনা আবদুকা ওয়া আনা আ'লা আহদিকা ওয়া ও'য়াদিকা মা'স্তাত'তু আ'উজু বিকা মিন শাররি মা ছানাতু আবু'উ লাকা বিনি'মাতিকা আ'লাইয়া ওয়া আবু'উ বিনাবী ফাঘফিরলী ফাইন্নাহু লা ইয়াগফিরুযযুনু'বা ইল্লা আন্তা।
অর্থ: হে আল্লাহ! আপনি আমার প্রভু, আপনার ছাড়া আর কোনো উপাস্য নেই। আপনিই আমাকে সৃষ্টি করেছেন। আমি আপনার দাস এবং আমি আপনার অঙ্গীকার ও প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী যতটুকু পারি। আমি আমার কর্মের মন্দ থেকে আপনার আশ্রয় প্রার্থনা করছি। আমি আপনার কাছে স্বীকার করছি যে, আপনি আমার প্রতি যে সমস্ত অনুগ্রহ করেছেন, আমি তার শুকরিয়া আদায় করছি এবং আমার গুনাহও স্বীকার করছি। আপনি আমাকে ক্ষমা করুন, কারণ আপনি ছাড়া আর কেউ গুনাহ মাফ করতে পারে না।
তাওবা ও ইস্তেগফারের নিয়ম
১. খাঁটি নিয়ত করা: তাওবা করতে হলে মন থেকে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়া ও সত্যিকারের পাপের জন্য অনুতপ্ত হওয়া জরুরি।তাওবা বা ইস্তেগফারের যেকোন দোয়া শুধু পড়লেই হবে না তার জন্য থাকতে হবে খাঁটি নিয়ত। অন্তর থেকে মানতে হবে আমি ভুল করেছি এবং একনিষ্ঠ ভাবে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতে হবে।
২. পাপ বর্জন: তাওবা বা ইস্তেগফার করে যদি আবার বা বার বার ঐ একই ভুল করি তাহলে তাওবার কোন মূল্য রইল না। তাওবা করার পর পাপ কাজ থেকে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে বিরত রাখা এবং ভবিষ্যতে এই পাপ আর না করার দৃঢ় সংকল্প করতে হবে।
৩. পূর্ব পাপের ক্ষতিপূরণ: যদি ভুল এমন হয় যার কারণে অন্য কারও ক্ষতি হয়ে থাকে, তবে সেই ক্ষতি পূরণ করার চেষ্টা করতে হবে।সাথে তার কাছে ও আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতে হবে।
৪. নিয়মিত পড়া: তাওবা বা ইস্তেগফার একটি গুরুত্বপূর্ণ আমল যার মাধ্যমে আমরা ইহকাল ও পরকাল দুই জগতেই পেতে পারি আল্লাহর রহমত। তাই আমাদের প্রতিদিন ইস্তেগফার করা এবং আল্লাহর কাছ থেকে ক্ষমা চাওয়ার অভ্যাস করা উচিত।
সুতরাং মুমিন মুসলমানের উচিত, গুনাহ করার সময়ের কথা না ভেবে আর দেরি না করে আল্লাহর কাছে তওবা করা। দেরি হয়ে গেলেও আল্লাহর কাছে তওবা করে গুনাহ থেকে ফিরে আসা। হাদিসের ওপর যথাযথ আমল করা। গুনাহমুক্ত জীবন গড়া। তবেই তওবাকারী হবেন সফল। যেভাবে বলেছেন আল্লাহ-
وَتُوْبُوْا إِلَى اللهِ جَمِيْعاً أَيُّهَا الْمُؤْمِنُوْنَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُوْنَ
'হে মুমিনগণ! তোমরা সবাই আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন কর, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার।' (সুরা নুর : আয়াত ৩১)
আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে বেশি বেশি তাওবা বা ইস্তেগফার করার তাওফিক দান করুন যাতে আমরা সবাই আল্লাহর প্রিয় বান্দা হতে পারি।আমিন।